দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিয়ে লাখ লাখ পরিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে সফল হয়ে জয়ের মুকুট পরা সত্যিই দু:সাধ্য। এজন্য প্রয়োজন সঠিক নির্দেশনা ও সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিকল্পিত পড়াশোনা ও লক্ষ্যের প্রতি স্থির থাকলে সফলতা অসবেই।
চ্যানেল আই অনলাইনের মাধ্যমে বিসিএস পরিক্ষার্থীদের এ যাত্রাপথ সহজ করতে পরামর্শ দিয়েছেন বিসিএসে সফল হয়ে বিভিন্ন ক্যাডারে কর্মরত কয়েকজন মেধাবী কর্মকর্তা।
গণিত আর ইংরেজিকে বিসিএসে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করেন ৩০ তম বিসিএস’র মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহী। এ দুটি বিষয়ে ভালো দক্ষতা থাকলে যে কোন প্রতিযোগীতায় সফলতা সহজ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া অন্য কোন বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে তা পড়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্বল বিষয়টি পরে পড়ব ভেবে রেখে দিলে দেখা যায়, সব বিষয়ে ভাল করা গেলেও ওই একটি বিষয়ে সঠিক জ্ঞানটা অার হয়ে ওঠে না। পরবর্তীতে সে বিষয়টি বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই যেকোন পড়া পরের দিনের জন্য ফেলে না রেখে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিসিএস’র জন্য কয়েক মাসের প্রস্তুতি না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষ থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন এই মেধাবী তরুণ কর্মকর্তা।
ইংরেজিতে দক্ষ হতে একটি সম্মিলিত প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এজন্য আজ থেকেই গ্রামার, ভোকাবুলারি, পেপার পত্রিকা পড়া শুরু করা যেতে পারে। একইসঙ্গে সপ্তাহে ১-২ টা ইংরেজি সাবটাইটেল সহ মুভি দেখা যেতে পারে। আর ইংরেজিতে দক্ষ হতে গ্রুপ করে বন্ধুদের সঙ্গে ইংরেজি চর্চার কোন বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে শব্দের প্রয়োগ, বাক্যের বিন্যাস, বাগধারা, প্রবাদ ইত্যাদিতে বৈচিত্র্য থাকলে নম্বর প্রাপ্তিতে অনেকটা এগিয়ে থাকা যায়।’
গণিতে যাদের দুর্বলতা রয়েছে তাদের সিলেবাস ধরে ক্লাস সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত অংক বই সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে সিলেবাসের প্রয়োজনানুযায়ী মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের কিছু অংশ দেখে নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সমাধান বই না দেখে নিজে নিজে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। প্রথম প্রথম কঠিন মনে হলেও চর্চা করতে থাকলে একসময় ঠিকই দক্ষ হওয়া যাবে।
এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য বিষয়ভিত্তিক মোটামুটি একটা ধারণা নেয়ার পর যত বেশী সম্ভব প্রশ্ন, মডেল প্রশ্ন সমাধান করা যেতে পারেে। এতে বেশি মনে থাকে। সময় থাকলে ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেনের সমাজ, বিজ্ঞান, ভূগোল ইতিহাস এই ধরণের বিষয়ের বইগুলো দেখে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিসিএস প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোচিং খুব বেশি জরুরি নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধুমাত্র তারাই কোচিং করতে পারেন যারা নিজেরা একা একা পড়াকে যথেষ্ট মনে করেন না। এক্ষেত্রে কোচিং আপনার ভেতরে একটা প্রতিযোগী মনোভাব তৈরী করতে পারবে। তিনি মনে করেন, একাগ্রতা নিয়ে শ্রম ও ধৈর্য্য ধরে পড়লে এবং সর্বোপরি ভাগ্য সহায় হলে সফলতা আসবেই।
৩৩ তম বিসিএস প্রশাসনে প্রথম অভিজিৎ বসাক মনে করেন বিসিএসে সফল হতে প্রথমেই প্রয়োজন লক্ষ্যের প্রতি স্থির থাকা। লক্ষ্যের প্রতি মনের মারাত্মক রকম দৃঢ়তাই এক্ষেত্রে সাফল্যের পথে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
বিসিএসে প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন চর্চা সাফল্য এনে দিতে পারে। এছাড়া প্রস্তুতির প্রথম ধাপে বিগত বছরের প্রশ্ন সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, এতে করে পরীক্ষার্থীরা দুটি বিষয় বুঝতে পারবে। কোন কোন বিষয়ে কতটুকু দক্ষতা আছে তাদের; আর এর পাশাপাশি প্রশ্নের ধরণটাও বোঝা হয়ে যাবে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নের ধরণ বুঝতে পারাটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
এক্ষেত্রে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার জন্য আলাদা প্রস্তুতি না নিয়ে সমন্বিত প্রস্তুতি অনেক বেশি কার্যকর বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, অষ্টম-নবম-দশম শ্রেণীর বইগুলো ভালমতো চর্চা করলে বেশিরভাগ কাজ হয়ে যাবে। প্রথমেই প্রচুর টপিক না পড়ে পরীক্ষার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো ভালমতো শেষ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
‘প্রয়োজনে একই টপিক বার বার পড়ুন। কিন্তু যেটা শিখবেন ভালমতো শিখবেন। গুরুত্বপূর্ণ চলমান ঘটনা সম্পর্কে ধারণা রাখতে নিয়মিত পত্রিকা পড়ুন।’
তিনি বলেন, প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতে সাধারণত অর্ধেকের একটু বেশি মার্ক পেলেই উত্তীর্ণ হওয়া যায়। তাই এখানে অনেক বেশি মার্ক টার্গেট নেয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার ভাল ফলাফল প্রত্যাশিত ক্যাডার পাবার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে রাখবে। লিখিত পরীক্ষায় প্রচুর তথ্য-উপাত্ত, ছক, চিত্র ব্যবহার করলে ভাল নম্বর পাওয়া যায়। আর ভাইভার জন্য প্রয়োজন একটি সার্বিক প্রস্তুতি। এক্ষেত্রে লক্ষ্য স্থির রেখে চেষ্টা চালিয়ে গেলে, সফলতা আসবেই।
বিসিএস প্রস্তুতির বিষয়ে গৎবাঁধা প্রস্তুতির বদলে টেকনিক্যাল প্রস্তুতি অনেক বেশি সহায়ক বলে মনে করেন ৩৪ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ১১ তম মেধাস্থান অর্জনকারী শামীম আনোয়ার।
তার মতে, যেহেতু প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর রিটেন প্রস্তুতির জন্য তেমন সময় হাতে থাকে না, তাই প্রস্তুতির ধরণটা এমন হওয়া চাই, যেন প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির সময় একইসঙ্গে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির একটা বড় অংশও কভার হয়ে যায়।
তিনি বলেন, একটু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিকল্পনা সাজালে দেখা যাবে প্রিলিমিনারি ও রিটেনের প্রস্তুতি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে একই। তাই প্রস্তুতি পরিকল্পনা করার সময় সাফল্য প্রত্যাশীদের যথেষ্ট স্মার্ট হওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
কতক্ষণ পড়তে হবে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কতক্ষণ পড়তে হবে এটা মূলত নির্ভর করবে পরীক্ষার্থীর ধারণ ক্ষমতা, মনোযোগ, পারিপার্শ্বিকতা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, দু’ঘন্টায় অনেক কিছু পড়া হয়ে গেছে, আবার অন্য সময় দেখা গেল সারাদিন বই সামনে নিয়ে বসে থেকেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই কতক্ষণ পড়লাম, তার চাইতে কতটুকু পড়লাম তার ওপর গুরুত্বারোপ করাটা অধিক জরুরী।
তবে ৩৮ তম বিসিএসে যারা অংশ নেয়ার পরিকল্পনা করছেন, তারা এখন থেকে কমপক্ষে ৭/৮ ঘন্টা পড়াশুনা করলে ভাল অবস্থানে থাকা নিশ্চিত বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা
বিসিএস পরীক্ষায় সফলতা লাভের ক্ষেত্রে কোচিং এর প্রয়োজনীয়তা কতখানি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, গ্রুপ স্টাডি করছে, ইংরেজি-গণিত-বিজ্ঞানের মত বিষয়গুলো নিজেরা চেষ্টা করে বুঝার মতো আত্মবিশ্বাস আছে, চাইলেই হেল্প করার বা পরামর্শ দেয়ার মতো পরিচিত বিসিএস ক্যাডার বা অভিজ্ঞ কেউ আছেন তাদের জন্য কোচিং এর তেমন প্রয়োজন নেই।’
তবে যারা একা একা পড়াশুনা করেন, স্টাডি পার্টনার নেই তারা কোচিং করতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।
কোন পদ্ধতিতে প্রস্তুতি অধিক কার্যকরী, এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, এটা আসলে নির্ভর করে প্রস্তুতিটা কোন সময়ে নেয়া হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্বে অনেক সময় হাতে থাকলে, বেসিক গঠন যেমন- ফ্রিহ্যান্ড বাংলা ও ইংলিশ রাইটিং, ভোকাবুলারি, নিয়মিত ইংরেজি পত্রিকা পড়া, মাধ্যমিক পর্যায়ের গণিত ও সাধারণ বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞানের বই মুখস্থ না করে ওই বইয়ে আলোচিত বিষয়সমূহ বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা প্রভৃতি বিষয়ে জোর দিতে হবে।
তবে যারা ৩৮ বা ৩৯ তম বিসিএসে অংশ নিতে চান, তাদের প্রস্তুতি হতে হবে তুলনামূলক সরাসরি। যেমন- ভালমানের বিভিন্ন বই বা গাইড ফলো করা বা কোচিং করার মাধ্যমে তারা এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে পরেন বলে জানিয়েছেন তিনি।