দিন দিন মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্প্রসারিত হলেও সমাজের এ স্তরের মানুষের চাকরির সুযোগ বাড়ছে না। বরং খেয়েপরে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার মতো চাকরির জায়গা সীমিত হচ্ছে মধ্যবিত্তের।
নিরাপদ, সম্মানজনক জীবিকা হিসেবে সরকারি চাকরিই প্রথম পছন্দ গড়পড়তা মধ্যবিত্ত পরিবারের। বছরে পাবলিক সার্ভিস কমিশন গড়ে দুই হাজার ক্যাডার অফিসার নিয়োগ করে। মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানদের জন্য ভদ্রগোছের সম্মানজনক সরকারি চাকরি বলতে এটুকুই। এর বাইরে চাকরির বড় বাজার হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকতা, যেখানে মূল বেতন আসে
সরকারি কোষাগার থেকে। এমপিও বন্ধ থাকায় সেই শিক্ষক নিয়োগও হচ্ছে না অনেক দিন। চাকরির ভরসা বলতে শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাত।
চাকরির সুযোগ সীমিত হচ্ছে মধ্যবিত্তের
ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে আড়াই লাখ পদ শূন্য। এসব পদে নিয়োগ দিতে নানা বাধা। পছন্দের প্রার্থী নিয়োগ দিতে মন্ত্রী-আমলারা নিয়ম-কানুন বদলে ফেলেন। যাদের আত্মীয়স্বজনের তালিকায় মন্ত্রী-এমপি-আমলা নেই, তাদের চাকরিও নেই। সরকারি চাকরির আরো বড় বাধা হচ্ছে, নিয়ম-কানুনের অভাব। এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারী এসব নিয়ম-কানুন যুগোপযোগী করার কাজে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে সরকারের অনুমোদনের পরও নতুন সরকারি চাকরি সৃষ্টি হয় না, বিদ্যমান শূন্য পদও পূরণ হয় না।
ঘুষ-অনিয়মের অভিযোগ পিছু ছাড়ের না সরকারি চাকরির নিম্ন পদে। এ সরকারের গত মেয়াদে খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ নিয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ভর্তি পরীক্ষায় যে প্রার্থী আট পেয়েছে তাকে দেওয়া হয়েছে ৮৯। ১৯ কে করা হয়েছে ৯১। এভাবে তিলকে তাল করে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দিতে গিয়ে তা আদালতে আটকে যায়। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনেরও নজরে এসেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমপি আর আমলাদের প্রার্থী আটকে যাওয়ায় মামলার জট খোলার চেষ্টা করে না কেউ। আর দুর্লভ চাকরি থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে যোগ্য প্রার্থীদের।
শুধু খাদ্য অধিদপ্তরই নয়, সরকারের সব দপ্তরের চিত্রই কমবেশি এক। অনেক দপ্তরে পুরো নিয়োগ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়ে নেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী একাই। মন্ত্রণালয়ের চিফ এক্সিকিউটিভ হিসেবে তিনি যা বলেন, তাই করতে বাধ্য হন আমলারা। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টিং অফিসার হিসেবে সচিব যখন সুযোগ পান তিনিও কম যান না। এ ছাড়া অন্য কর্মকর্তারা তো রয়েছেনই।
মধ্যবিত্ত ঘুষ দিয়েও চাকরি পেতে চায়। কিন্তু কার কাছে ঘুষ দিলে চাকরির নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে—তা না ধরতে পারায় চাকরিও তাদের অধরা থেকে যায়। আর এ সুযোগটিও কাজে লাগান অনেক মন্ত্রী-এমপি-আমলা। তাঁদের নামে এক পদের বিপরীতে একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। এদের মধ্যে নিজেদের যোগ্যতায় প্রার্থী চাকরি পেয়ে যায় কেউ কেউ। সেই সব প্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়া ঘুষের টাকা হজম করতে কোনো সমস্যা হয় না। তখন বাকি প্রার্থীরা ঘুষ হিসেবে দেওয়া টাকা ফেরত নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। অনেক দিন ঘুরে কিছু টাকা ফেরতও পায় অনেকে। তবে পুরো টাকা উদ্ধার করতে পারে না তারা। বেকারত্বও ঘোচে না তাদের। উচ্চবিত্তের ঘুষ দিয়ে চাকরি পেতে সমস্যা নেই। নিম্নবিত্তের তো ঘুষ দেওয়ার সাধ্য নেই।
লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে আসে মধ্যবিত্তের সন্তানদের। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দফায় দফায় হলেও চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কেউ নেয় না। কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে টুঁ শব্দটি করেন না। যখনই কোনো উচ্চপদস্থ আমলার অবসরের সময় আসে, তিনি প্রভাব বিস্তার করে সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ানোর জন্য ফাইল নীতিনির্ধারকদের সামনে পেশ করেন। সব ক্ষেত্রে সাফল্য না এলেও অনেক ক্ষেত্রেই ওই প্রভাবশালী আমলার ভাগ্য খুলে যায়। তিনি চুক্তিতে নিয়োগও পেয়ে যান।
২০০৯ সাল থেকে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ার প্রস্তাব অর্ধডজন বার করা হলেও চাকরির প্রবেশিক পদে বয়স বাড়ানোর প্রস্তাব একবারও হয়নি। সদ্য পড়াশোনা শেষ করা বেকারদের মানসিক যন্ত্রণা বোঝেন না আমলারা। তাঁরা শুধু তাঁদের অবসরের বয়স বাড়ানোর চিন্তা করবেন—সেটাই যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশেই সরকার গঠনের সময় নতুন চাকরির বাজার সৃষ্টির ঘোষণা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও দিয়েছেন। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে মহাজোটের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময়ও ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ভিশন ২০২১-এ চাকরির বাজার সৃষ্টি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল। সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়নি।
নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরা চতুর্থ শ্রেণির চাকরি বা ২০তম গ্রেডের চাকরি পেলেও খুশি। সরকারি একটা চাকরি পেলে নিশ্চিন্তমনে জীবন পার করার স্বপ্ন দেখে তারা। সেই স্বপ্নেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের আউটসোর্সিং পলিসি। এই পলিসির অংশ হিসেবে সরকার চতুর্থ শ্রেণিতে আর রাজস্ব খাত থেকে নিয়োগ দেবে না। ২০তম গ্রেডের যেকোনো পদ থেকে অবসরে গেলে তা আউটসোর্সিং করা হবে। বিভিন্ন আউটসোর্সিং কম্পানি এসব পদে লোক নিয়োগ দেবে। তারা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে মাসে মাসে কমিশন পাবে। আউটসোর্সিংয়ের আওতায় যাদের নিয়োগ করা হবে, তারা বেতনের বাইরে কোনো সুবিধা পাবে না। সরকারি চাকরিজীবীরা ঈদের সময় বোনাস পেলেও তাদের কপালে তা জুটবে না। সরকারের এই নীতি ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার ঘোষণার উল্টো। বরং এসব পদ থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়ার পথই প্রশস্ত হচ্ছে।
চাকরির বাজারে মধ্যবিত্তের করুণ কাহিনি শুনিয়েছেন ল্যান্ড সার্ভেয়ার পদে চাকরিপ্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেছেন, এক যুগ আগে ল্যান্ড সার্ভেয়ার পদে ৩০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষাও নেওয়া হয়। এরপর ভূমি মন্ত্রণালয় আর অগ্রসর হয়নি।
তবে থেমে যাননি তাঁর মতো আরো কয়েক চাকরিপ্রার্থী। তাঁরা উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। সেখান থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে চাকরি দেওয়ার জন্য। সাজ্জাদের কণ্ঠে এখন আত্মবিশ্বাসের সুর। তিনি বলেন, ‘আমরা এক যুগ ধরে এই চাকরির পেছনে লেগে আছি। আদালত ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। তার পরও আমরা আশাবাদী, চাকরি আমাদের হবেই। কারণ আমাদের চাকরি না দিয়ে শূন্য পদে লোক নিয়োগ করতে পারবে না ভূমি মন্ত্রণালয়। ’
তবে সমস্যাও বাড়ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওই চাকরিতে শূন্য পদেও সংখ্যা এখন ৬০০। তৃতীয় শ্রেণির পদ এখন হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির। আগে এ পদে মন্ত্রণালয় সরাসরি নিয়োগ দিতে পারত। এখন সেই পদে নিয়োগ দেবে পিএসসি। তবু আশা হারাননি সাজ্জাদ। তাঁর ভরসা—আদালতের নির্দেশনা।
বর্তমানে চাকরির সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে বেসরকারি খাত। কিন্তু বেসরকারি চাকরি আজও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। সরকারি চাকরি যেমন একটি নিয়ম-নীতিতে দাঁড়িয়েছে, বেসরকারি চাকরিতে তা আজও হয়নি। সরকার বিভিন্ন সময় যেসব সুবিধা দেয় বেসরকারি পর্যায়েও তা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়। কিন্তু তা মানা হয় কি না, তা তদারকি করা হয় না। সরকার গত বছর থেকে বৈশাখী উৎসব ভাতা দিচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের কর্মীদের বৈশাখী ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেলে একটা বড় অঙ্কের পেনশন পাওয়া যায়। সরকার বেসরকারি পর্যায়েও পেনশন চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ওই ঘোষণা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। সরকারি চাকরিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসের। বেসরকারি চাকরিতেও একই সমান মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার কথা। কিন্তু মানা হয় না। এই না মানার যে ফল তা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেই ভোগ করতে হয় বেশি।
যাদের সরকারি-বেসরকারি চাকরি কোনোটাই হচ্ছে না তারা নানাভাবে বাঁচার চেষ্টা করে। কেউ ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কেউবা পাড়ি জমায় বিদেশে। এসব চেষ্টায়ও নানা ধরনের হতাশা কাজ করছে, ঝুঁকিও কম নয়।
ব্যবসায়ীরা দাবি করে আসছে, দিন দিনই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আর যারা কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দেয় সেখানেও চলছে নানা অনিয়ম। প্রবাসীদের বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। অভিবাসন ব্যয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত শ্রেণির বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রম আমদানিকারক দেশ সৌদি আরবে যেতে হলে কমপক্ষে ছয় লাখ টাকা দরকার হয়। আর মালয়েশিয়ায় সরকার নির্ধারিত টাকায় যাওয়ার সুযোগ থাকলেও এই প্রক্রিয়ায় লোক নিয়োগের হার খুবই কম। জমি বিক্রি আর ধারদেনা করে শেষ পর্যন্ত কেউ বিদেশে পাড়ি জমালেও আয়ের নিশ্চয়তা নেই। প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়ে মাঝপথে দেশে ফেরত এসে পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে হয় মধ্যবিত্তের অনেক ভাগ্যাহত সন্তানকে। সূত্রঃ কালের কন্ঠ